দুর্গাপূজা মানেই শিউলি ফুলের গন্ধ, নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘ, আর সব থেকে বড় কথা, মন মাতানো ঢাকের বোল। এই ঢাকের বাদ্যি ছাড়া বাঙালির দুর্গাপূজা অসম্পূর্ণ। দেবী দুর্গার আগমনে যে উৎসবের সূচনা হয়, সেই উৎসবকে প্রাণবন্ত করে তোলেন ঢাকিরা। দেবীকে প্যান্ডেলে স্বাগত জানানো থেকে শুরু করে আরতি, সন্ধিপূজা, আর বিসর্জনের করুণ সুর-সবই তাদের ঢাকের তালে তালে বাঁধা। কিন্তু এই ঢাকিদের জীবনের গল্পটা কেমন? উৎসবের আলোর আড়ালে তাদের জীবন কতটা অন্ধকারে ঢাকা, তা নিয়েই এই প্রামাণ্য নিবন্ধ। দুর্গাপূজা শুধু দেবী আরাধনার একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতি ও আবেগের উৎসব। পূজার প্রতিটি মুহূর্তে যে বাদ্যযন্ত্রটি আবেগকে চরমে পৌঁছে দেয়, তা হলো ঢাক। আর এই ঢাক বাজিয়ে উৎসবের রঙ আরও গাঢ় করে তোলেন ঢাকিরা। দেবীকে স্বাগত জানানো থেকে শুরু করে আরতি, সন্ধিপূজা এবং বিসর্জনের সময় ঢাকির তালে উৎসবের আবহ যেন এক অনন্য মাত্রা পায়।

উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ: ঢাকিদের ভূমিকা
দুর্গাপূজার প্রতিটি ক্ষণ ঢাকিদের হাতের জাদুতে প্রাণ পায়। এই বাদ্য শুধু একটি সুর নয়, এটি আনন্দ ও ভক্তির এক প্রকাশ। ঢাকিরা যেন এই উৎসবের প্রাণ, তাদের বাদ্য একাধারে দেবীকে স্বাগত জানানোর প্রতীক এবং উৎসবের উত্তেজনা।
- পূজার সূচনা থেকে বিসর্জন পর্যন্ত: দেবীর আগমনী থেকে শুরু করে দেবীকে বিদায় জানানোর সময় পর্যন্ত, ঢাকিরা বিভিন্ন তালে ঢাক বাজিয়ে যান। আরতির সময় তাদের ছন্দময় বাদ্যে ভক্তির এক অন্যরকম রূপ দেখা যায়, আর বিসর্জনের সময় সেই একই ঢাকে বাজে বিষাদের করুণ সুর।
- ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক: ঢাক বাজানো শুধু একটি পেশা নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যুগ যুগ ধরে ঢাকিরা এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে এই শিল্পকে প্রবাহিত করে চলেছেন। তারা শুধুমাত্র বাদ্যকার নন, তারা আমাদের সংস্কৃতির বাহক।
দুর্গাপূজার প্রতিটি স্তরে ঢাকের বাদ্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি কেবল একটি বাদ্যযন্ত্র নয়, দেবীর আগমনের প্রতীক, আনন্দের বহিঃপ্রকাশ এবং আবেগের অনুরণন।
- আরতি ও সন্ধিপূজা: ঢাকিরা বিভিন্ন তালে ঢাক বাজিয়ে ভক্তির আবহ তৈরি করেন। ঢাকের শব্দে মিশে যায় উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, যা পূজার মুহূর্তকে ভক্তিময় করে তোলে।
- সন্ধিপূজা: এই বিশেষ সময়ে ঢাকের তালে এক অন্য রকম উত্তেজনা তৈরি হয়, যা পূজার পরিবেশকে চরমে নিয়ে যায়।
- বিসর্জন: বিদায়ের মুহূর্তেও ঢাকিরা সেই বেদনাকে ও উৎসবের আনন্দকে একসাথে তুলে ধরেন, যেখানে ঢাকের আওয়াজে লুকিয়ে থাকে আবেগ, বেদনা ও উদ্দীপনা।

ঢাকির জীবন: উৎসবের আড়ালে কঠিন বাস্তবতা
দুর্গাপূজার পাঁচটা দিনের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন ঢাকিরা। কারণ এই ক’টা দিনই তাদের প্রধান রোজগারের উৎস। মূলত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকা থেকে তারা পূজার সময় শহরে এসে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে কাজ করেন। ঢাকিরা মূলত গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দা। দুর্গাপূজা তাঁদের কাছে শুধু শিল্প প্রদর্শনের সুযোগ নয়, এটি অর্থ উপার্জনের প্রধান সময়। পূজার কয়েকদিন শহরের বিভিন্ন প্যান্ডেলে বাজিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন।
কিন্তু পূজার বাইরে তাঁদের জীবন অনেক কঠিন। সারাবছর ঢাক তৈরি করা বা অন্য ছোটখাটো কাজ করেই জীবন চালাতে হয়। অনেক সময় এই পেশা ছেড়ে অন্য কাজে যেতে বাধ্য হন। বিশেষত, আধুনিক বিনোদন মাধ্যমের দাপটে ঢাকের চাহিদা ধীরে ধীরে কমছে। ফলে, বহু ঢাকি পেশা পরিবর্তন করেছেন।
- জীবিকার কঠিন লড়াই: উৎসবের আনন্দের বাইরে তাদের জীবন সাধারণত খুব কঠিন। অনেকেই দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করেন, এবং তাদের কাছে ঢাক বাজানোই একমাত্র রোজগারের পথ। পূজার পর তাদের জীবনে নেমে আসে চরম আর্থিক অনটন, যখন কাজ প্রায় থাকেই না।
- পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ: সময়ের সাথে সাথে এই পেশার চাহিদা কমে আসছে। অনেকেই জীবিকার তাগিদে এই ঐতিহ্য ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এর প্রধান কারণ, সারা বছর ধরে রোজগারের অনিশ্চয়তা। নতুন প্রজন্মও এই পেশায় আসতে চাইছে না, কারণ এর ভবিষ্যৎ খুব একটা উজ্জ্বল নয়।
কিছু ঢাকি তাঁদের সন্তানদের এই শিল্প শেখানোর চেষ্টা করছেন। তবে অর্থাভাব ও কাজের সুযোগের সংকটে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। তবুও, ঢাকিদের দৃঢ় প্রত্যয় এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য প্রশংসনীয়। সাম্প্রতিক কালে কিছু সামাজিক সংগঠন এই শিল্পীদের প্রশিক্ষণ ও স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এমনকি মহিলারাও এখন ঢাক বাজানোয় যুক্ত হচ্ছেন, যা পেশাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করছে।

এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু সংগঠন এবং সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এখন ঢাকিদের জীবনযাত্রার উন্নতিতে কাজ করছে। তাদের কাজকে স্বীকৃতি দিতে বিভিন্ন তথ্যচিত্র ও প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে। এটি তাদের লড়াইকে তুলে ধরছে এবং তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে সহায়তা করছে।
- নারীর ক্ষমতায়ন: কিছু জায়গায় এখন মহিলারাও ঢাক বাজানো শিখছেন এবং এই পেশায় আসছেন। এটি একটি খুবই ইতিবাচক পরিবর্তন, যা শুধুমাত্র এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখছে না, বরং এই পেশাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলছে।
দুর্গাপূজার ঢাক শুধু একটি বাদ্যযন্ত্র নয়। এটি আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি আর আমাদের আবেগের এক প্রতিচ্ছবি। এই ঢাকের প্রতিটা বোলের পেছনে লুকিয়ে আছে এক-একজন ঢাকির কঠিন জীবন সংগ্রাম। তাদের নিঃস্বার্থ শ্রমেই আমাদের উৎসব পূর্ণতা পায়। আসুন, আমরা সেই নীরব শিল্পীদের সম্মান জানাই, যারা আমাদের ঐতিহ্যকে সজীব রাখতে আজও অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন।
All images captured & © by Debraj Biswas. Owned by Wiki Kolkata. Reproduction or use without permission is strictly prohibited.