কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে এক অনন্য পাড়া আছে – কুমারটুলি। নামেই যার পরিচয় – ‘কুমার’ অর্থাৎ মৃৎশিল্পী এবং ‘টুলি’ অর্থাৎ বসতি। শতাব্দী প্রাচীন এই এলাকা আজ শুধু কলকাতার নয়, সমগ্র বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। দুর্গাপূজা যখন কলকাতার সবচেয়ে বড় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে, তখন তার আত্মা লুকিয়ে রয়েছে এই কুমারটুলির সরু গলি, মাটির গন্ধ আর শিল্পীদের পরিশ্রমে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
কুমারটুলির জন্ম ঔপনিবেশিক আমলে। আঠারো শতকে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা যখন সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা মিলিয়ে নতুন শহর গড়ে তুলছিলেন, তখন শিল্পী ও কারিগরদের জন্য আলাদা আলাদা পাড়া গড়ে তোলা হয়। সেই সময় থেকেই কুমাররা এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। প্রথমে তারা ঘরোয়া পুজোর জন্য মূর্তি বানাতেন, পরে জমিদারবাড়ির পূজা ও পরবর্তী সময়ে বারোয়ারি পূজার কল্যাণে তাদের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়।
মাটির গন্ধে গড়ে ওঠা দেবীমূর্তি
দুর্গাপূজার প্রস্তুতি শুরু হয় বহু মাস আগে। গঙ্গার পাড় থেকে মাটি আনা, খড় দিয়ে কাঠামো বেঁধে প্রতিমা দাঁড় করানো, তারপর মাটির প্রলেপে দেবীর শরীর গঠন – সবই হয় নিপুণ হাতে। একে একে শুকানো, রঙ তোলা, চোখ আঁকা – এই পুরো প্রক্রিয়া যেন এক শিল্প-যাত্রা। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত হলো চক্ষুদান । বিশ্বাস করা হয়, সেই দিন দেবীর প্রাণ প্রতিমায় আবাহিত হয়।

শিল্পের আন্তর্জাতিকীকরণ
আজ কুমারটুলি শুধু কলকাতার দুর্গাপূজার জন্যই নয়, আন্তর্জাতিক শিল্পবাজারেও খ্যাতি অর্জন করেছে। লন্ডন, নিউইয়র্ক, টরন্টো, সিডনি – প্রবাসী বাঙালিদের দুর্গোৎসবের জন্য এখানকার শিল্পীরা দেবী পাঠান সমুদ্রপথে। শুধু দুর্গামূর্তি নয়, গণেশ, সরস্বতী, লক্ষ্মী কিংবা ক্রিসমাসের জন্য সান্তা ক্লজের মূর্তিও কুমারটুলি থেকে রপ্তানি হয়।
চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রাম
তবু এই শিল্পপল্লির জীবন সবসময় সহজ নয়। প্লাস্টার অফ প্যারিস ও যান্ত্রিক প্রযুক্তির প্রতিযোগিতা, আর্থিক অনিশ্চয়তা, বন্যা বা বৃষ্টিতে ক্ষতি – সবই শিল্পীদের প্রভাবিত করে। তবু তাদের একাগ্রতা, অভিজ্ঞতা আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আসা কৌশলই এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছে।

দুর্গাপূজা ও কুমারটুলির সামাজিক তাৎপর্য
কলকাতার দুর্গাপূজা ইউনেস্কোর Intangible Cultural Heritage তালিকায় স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতির অন্তরালে কুমারটুলির শিল্পীদের অবদান অপরিসীম। তাদের হাতেই দেবী মর্ত্যে আবাহিত হন, তাদের শিল্পেই মণ্ডপসজ্জা অর্থবহ হয়ে ওঠে, আর তাদের পরিশ্রমেই কোটি মানুষের আনন্দের উৎসব সম্ভব হয়।
কুমারটুলি কেবল একটি ভৌগোলিক এলাকা নয়, এটি বাংলার সংস্কৃতির আত্মা। দুর্গাপূজা যেমন বাঙালির হৃদয়ের উৎসব, তেমনি কুমারটুলি তার শিকড়। মাটির গন্ধ, শিল্পীদের ঘাম, আর আধ্যাত্মিক বিশ্বাস মিলিয়ে কুমারটুলি কলকাতার দুর্গোৎসবকে প্রতি বছর নতুন প্রাণে জাগিয়ে তোলে।
Cover Captured By : Sunannya Das | Owned by : Wiki Kolkata
