কলকাতা শহরের পুরোনো অলি-গলিতে হাঁটতে হাঁটতে অনেক সময়ই চোখে পড়ে ভগ্নপ্রায়, অথচ ইতিহাসে ভরপুর কিছু স্থাপত্য। এমনই এক বিস্মৃত সৌধ উত্তর কলকাতার নীলমণি সরকার লেনে দাঁড়িয়ে আছে – বামাচরণ ভড়ের বসতবাটি, যা আজ পরিচিত ব্রজকিশোর ঠাকুরবাড়ি নামে।
বাইরে থেকে দেখলে এটিকে বিশেষ কিছু মনে হয় না। সরু গলি, সাদামাটা ফটক। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করলেই যেন খুলে যায় এক অচেনা জগত। ১৮৬৫ সালে নির্মিত এই লাল ইটের দোতলা বাড়ি আজও প্রায় অবিকল দাঁড়িয়ে আছে দেড়শ বছরের সাক্ষী হয়ে।

বামাচরণ ভড় জন্মেছিলেন ১৮৫১ সালে, দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ভাগ্যের খোঁজে তিনি পাড়ি দেন কলকাতায় – সেই সময়ের ইংরেজশাসিত নগরী, যেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্ফোরণ ঘটছিল। শ্রমিকের জীবন দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন সফল ব্যবসায়ী। তাঁর কীর্তির প্রতিফলনই এই বসতবাড়ি। চারপাশ ঘিরে ঘর, বারান্দা, আর মাঝখানে উঠোন – তৎকালীন জমিদার বাড়ির রীতি মেনে তৈরি। অন্দরমহলের পৃথক উঠোন, আর সেখানে এখনো টিকে আছে রাধামাধবের মন্দির ।
প্রধান ফটক পেরোলেই চোখে পড়ে কূলদেবতার আসন। এখানেই বিংশ শতকের শুরুর দিকে নিয়মিত আয়োজিত হত মধুর কীর্তন। ভক্তজনের ভিড়ে উঠোন থাকত সরগরম। আজও বংশধরেরা এই মন্দিরে নিত্যপূজা করে চলেছেন।
বাড়ির বহিরঙ্গ হয়তো সাধারণ, কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অনন্য শিল্পকলা। গথিক ও মুঘল রীতির সংমিশ্রণে তৈরি একাধিক আর্চ, খড়খড়িযুক্ত বারান্দা, লোহার রেলিং আর বাহারি পেনডেন্টিভ যেন সময়ের ক্যানভাসে এঁকে দিয়েছে বিস্ময়। ছাদের পাঁচিলে সূক্ষ্ম কারুকার্য, আংটায় আটকানো ঝালরের নকশা, আর কাঠের রেলিং-যুক্ত মার্বেল সিঁড়ি এখনো ধরে রেখেছে প্রাচীনতার ছোঁয়া। জলছাদ তৈরির পুরোনো কৌশল – চুন, সুরকি, গুড়, শঙ্খগুঁড়ো, ডাল ও মশলা মিশিয়ে পেটানো মসলা – আজও ছাদের ভাঁজে ভাঁজে ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে।

বামাচরণের মৃত্যুর পর ব্যবসার লাগাম নাকি ধরেন তাঁর সঙ্গী ক্ষেত্রমোহন দে। তবে এ নিয়ে স্পষ্ট প্রমাণ মেলে না। ক্ষেত্রমোহনের নিজস্ব কোম্পানি আগেই ছিল – বস্ত্রব্যবসার পাশাপাশি তিনি ছিলেন নিলামঘরের মালিকও। আন্দামান থেকে আনা কাঠের নিলামে তাঁর প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষ আলোচ্য।
সময়ের সঙ্গে পাল্টেছে কলকাতার ব্যবসার মানচিত্র। মারোয়াড়ি বণিকদের আগমন, স্টক এক্সচেঞ্জের গঠন, বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত – সব মিলিয়ে বাঙালির ব্যবসায়িক আধিপত্য হারিয়ে যেতে থাকে। স্বাধীনতার পরে সাহেবরা ব্যবসা বেচে দিলে সেগুলি একচেটিয়াভাবে অধিগ্রহণ করে মারোয়াড়িরা। বাঙালির ভাগ্যে জোটে চাকরিজীবনের নিশ্চয়তা, কিন্তু উদ্যোক্তার স্বপ্ন ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায়।

আজকের দিনে ব্রজকিশোর ঠাকুরবাড়ি শুধুই একটি পারিবারিক নিবাস নয় – এটি এক যুগের প্রতীক। সরু লেনে দাঁড়িয়ে থাকা এই লাল ইটের দোতলা বাড়ি যেন চুপচাপ স্মরণ করিয়ে দেয়, একদিন বাঙালির হাতেও ছিল বড় ব্যবসার স্বপ্ন, সাফল্যের গল্প, আর উদ্যোগপতির গৌরব। আজ সেই সব কাহিনি কেবল ইট, কাঠ আর আর্চে বন্দি হয়ে আছে – উত্তর কলকাতার নিঃশব্দ সাক্ষ্য হিসেবে।
All Image Captured by : Tanusree Sadhukhan | Owned by : Wiki Kolkata